ফেরা যাবে হাজার বছর পূর্বের ইতিহাসে

মহাবিশ্বের রহস্য খুঁজতে ইউক্লিড টেলিস্কোপ

ইউরোপিয়ান এই টেলিস্কোপটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বিজ্ঞান জগতের রহস্যময় নানা প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে। আমরা জানি, বিজ্ঞান জগতের অমীমাংসিত অনেক প্রশ্নের মধ্যে অন্যতম যে, এ মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে কি দিয়ে তৈরি! যেটির উত্তর এখনও অজানা শতাব্দীর পর শতাব্দী গবেষণা চালিয়েও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের ৯৫ শতাংশই অজানা হয়ে আছে আমাদের মানব সভ্যতার কাছে। 

টেলিস্কোপটির নামকরণ হয়েছে জ্যামিতির জনক গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিডের নামানুসারে। এটি স্পেসএক্স ফ্যালকন৯’ র মাধ্যমে স্থানীয় সময় বেলা ১১ টায় কেপ ক্যানাভেরাল মহাকাশ স্টেশন হতে উৎক্ষেপণ করা হয়।  এসময় টেলিভিশনে নাসা এটির সরাসরি সম্প্রচার করে। 

ইউরোপিয় স্পেস এজেন্সির উদ্যোগে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার খরচে এই টেলিস্কোপটি দূরবর্তী কোটি কোটি গ্যালাক্সির ছবি তুলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি নিখুঁত ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি ম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর বিজ্ঞানীরা এই ম্যাপের সাহায্যে কথিত ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে ধারণা পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। 

ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বে আমরা যা কিছু দেখি তার সবকিছুর আকার ও বিস্তৃতিকে এই দুটো জিনিসই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে গবেষকরা  অবশ্য স্বীকার করেছেন,  এই ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে তারা এখনো তেমন কিছুই জানেন না। এমনকি এর কোনোটি সরাসরি চিহ্নিতও করা যায়নি এখনও।

জানা গেছে, টেলিস্কোপটি অবস্থান করবে পৃথিবী থেকে ১৬ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। আর এটির গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক মাসের মতো। আর সেখানে ছয় বছর ধরে চালাবে পর্যবেক্ষণ । 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সাহায্যে ফিরে যাওয়া যাবে মহাবিশ্বের এক হাজার বছর আগের ইতিহাসে। পৃথিবীর পাশাপাশি ইউক্লিড সূর্যের চারদিকে একই গতিতে প্রদক্ষিণ করতেও সক্ষম বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

মহাকাশে অবস্থানের সময় বিশ্বমণ্ডলের ‘ডার্ক ইউনিভার্স’ পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি এটি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবে কিভাবে পৃথিবীতে ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর হতে মিল্কিওয়ে ভেদ করে আলো এসে পৌঁছায়।   

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যে ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ইসোবেল হুক বলেন, জ্ঞানের এই অভাবের কারণে আমরা আমাদের উৎস সম্পর্কে আসলেই কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারি না। এই ইউক্লিড মিশন থেকে যা কিছু জানা যাবে সেগুলো এই মহাবিশ্বকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।

তিনি বলেন, এই মিশন অনেকটা কোথায় স্থলভূমি আছে তা জানার আগে জাহাজে করে যাত্রা করার মতোই। এই গবেষণা থেকে জানার চেষ্টা করবো, আমরা এই মহাবিশ্বের কোথায় অবস্থান করছি, কিভাবে আজকের পর্যায়ে এসেছি এবং বিগ ব্যাং মুহূর্তের পর থেকে কিভাবে অপরূপ সব গ্যালাক্সি তৈরি হলো, কিভাবে তৈরি হলো সৌরজগত এবং জন্ম হলো প্রাণের?

দুই টনের এই টেলিস্কোপটি নানা ভারী যন্ত্রাশে সজ্জিত যা কিনা মহাবিশ্বের রহস্য ভেদ করার জন্য কাজ করতে মহাকাশের পথে রয়েছে। 

ইউরোপিয়ান এলইডি মিশন 

ইউক্লিডের নকশা ও প্রস্ততে মূলত ইএসএ প্রধান ভূমিকা রাখলেও কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তার দিক হতে নাসার অবদান রয়েছে যথেষ্ট। ১৩টি ইউরোপিয় দেশ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের প্রায় ২ হাজার বিজ্ঞানী এটি নির্মাণে গবেষণা করেছেন। 

ইউক্লিড মহাকাশে কী করবে?

পূর্বের নানা গবেষণা থেকে ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বে যতো শক্তি আছে তার ৭০ শতাংশ ডার্ক এনার্জি, প্রায় ২৫ শতাংশ ডার্ক ম্যাটার ও বাকি পাঁচ শতাংশ নক্ষত্র, তারকা, গ্যাস, ধুলোবালি, গ্রহ ও আমাদের মতো দৃশ্যমান বস্তু। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্যময় এই ৯৫ শতাংশ জগত সম্পর্কে ধারণা পেতেই ইউক্লিড টেলিস্কোপ ছয় বছর ধরে দুটি গবেষণা পরিচালনা করবে।

এর মধ্যে প্রধান কাজ হবে ডার্ক ম্যাটার কোথায় কিভাবে আছে তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। এই বস্তুটি সরাসরি চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দৃশ্যমান প্রভাবের কারণেই মহাবিশ্বে এরকম ম্যাটারের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এই ম্যাটারের উপস্থিতি না থাকলে গ্যালাক্সিগুলো তাদের আকৃতি ধরে রাখতে পারত না। আর এই শক্তি ‘স্ক্যাফল্ডিং’ হিসেবে কাজ করে। যা অনেকটা অদৃশ্য আঠার মতো মহাবিশ্বকে একত্রিত করে রেখেছে। 

ধারণা করা হয়, ডার্ক ম্যাটার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয় না, আবার এটি আলো শুষেও নেয় না, এমনকি এখানে আলো প্রতিফলিতও হয় না।

এই বস্তুটি সরাসরি দেখা না গেলেও টেলিস্কোপের সাহায্যে জানা সম্ভব এটা কোথায় ও কিভাবে রয়েছে। 

এর আগে হাবল স্পেস টেলিস্কোপও আকাশের মাত্র দুই বর্গ ডিগ্রি এলাকাজুড়ে প্রথমবারের মতো এই কাজটা করে আলোচিত হয়েছিল। এখন ইউক্লিড টেলিস্কোপ এই কাজটা করবে আকাশের ১৫ হাজার স্কয়ার ডিগ্রি এলাকাজুড়ে। এই কাজটি টেলিস্কোপের যে ভিআইএস ক্যামেরা দিয়ে করা হবে সেটা যুক্তরাজ্যের তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে।

এর আগে, এটি উৎক্ষেপণের জন্য রুশ ভিত্তিক সয়ুজ রকেটের কথা ভাবা হলেও পরে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা পরিবর্তন করে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স এর ওপরে বর্তায়। 

এদিকে শুক্রবার জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেসন রোডস এই অভিযানের বিষয়ে বলেন, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি সরাসরি নির্ণয় করা না গেলেও তাদের উপাদানসমূহ সম্পর্কে জানা যাবে।

সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //